ঢাকা , শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫ , ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

রাইসির মৃত্যুর নেপথ্যে খামেনির ছেলে?

আপলোড সময় : ২৫-০৫-২০২৪ ১০:৫১:০২ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় : ২৫-০৫-২০২৪ ১০:৫১:০২ পূর্বাহ্ন
রাইসির মৃত্যুর নেপথ্যে খামেনির ছেলে? সংগৃহীত
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ার ঘটনার আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে বৃহস্পতিবার। তবে প্রতিবেদন প্রকাশের পর হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার বিষয়ে আরও বেশি জল্পনা সৃষ্টি হয়েছে।

গত রোববার প্রতিবেশী আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র থেকে ফেরার সময় নিখোঁজ হয় রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার। নিখোঁজ হওয়ার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর প্রেসিডেন্ট রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানের মৃতদেহসহ ঘটনাস্থল সনাক্ত করা হয়।

এ ঘটনায় ষড়যন্ত্র থাকতে পারে, এমন জল্পনার খবর ছড়াতে থাকে রাইসির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত। তবে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করা হচ্ছে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির বড় ছেলে মোজতবা খামেনিকে। বিশ্লেষকদের মত, খামেনির পর সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল রাইসির। আর রাইসির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন খামেনির বড় ছেলে।

 এছাড়াও রাইসির মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেই দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি জনসমক্ষে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালিত হবে।

২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ড্রোন হামলায় যখন আইআরজিসি কমান্ডার কাশেম সোলাইমানি নিহত হয়েছিলেন তখন খামেনি কাঁদতে কাঁদতে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু রাইসির মৃত্যুর খবর ঘোষণার সময় তার কণ্ঠে সেরকম কোনো আবেগ দেখা যায়নি।

স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রকাশ করেছে (৬টি নিবন্ধসহ)।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চিত বক্তব্যের জন্য আমাদের আরও কিছু কাজ করা বাকি। এর জন্য  আরও সময় প্রয়োজন। তবে কিছু বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে। এখানে তা উল্লেখ করা হয়েছে। বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের অবশিষ্ট অংশে বুলেটের আঘাত বা এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। হেলিকপ্টারটি উচুঁতে উঠার পর আগুন ধরে যায়।’

এই অংশকে বিবৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করা হয়। কারণ, এখানে ইরানের জনগণকে বুঝানো হচ্ছে রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে বাইরের কোনো শক্তির ভূমিকা নেই।

একইভাবে বিবৃতির পরের অংশে বুঝানো হয়েছে, হেলিকপ্টারটি পূর্বপরিকল্পিত রুটেই যাচ্ছিল। নির্ধারিত রুট থেকে এটি বিচ্যুত হয়নি। ঘটনাটি কেবলই দুর্ঘটনা। প্রযুক্তিগত সমস্যা বা পাইলটের ভুল ছাড়া এর পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই।

তবে এই বিবৃতিতে নিছকই গল্প উল্লেখ করে উড়িয়ে দেওয়া যায়। কারণ এতে বিস্তারিত কোনো বিবরণ ছিল না। বিবৃতিতে যে উত্তরগুলো দেওয়া হয়েছে তাতে আরও বেশি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছে।

ইরানের সাংবাদিক ও ভাষ্যকার জামশিদ বারজেগারের মতে, ‘রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তার কোনো সমাধান নেই ওই বিবৃতিতে। বিবৃতিতে মূলত ইরানের সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে অন্যান্য বিশ্লেষক এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে সাধারণ ইরানিরা একমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, বিবৃতিটি সম্পূর্ণ ভুয়া। এর বেশি ‍কিছু নয়। যদিও বিবৃতিতে প্রচুর পরিমাণে প্রমাণ সংগ্রহ করার দাবি করা হয়েছে, কিন্তু এটাও বলা হয়েছে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার জন্য আরও নথি পরীক্ষা করতে হবে। এর জন্য আরও সময় প্রয়োজন।

যদি আরও প্রমাণসহ কোনো বিবৃতি প্রকাশ করাও হয় তবুও সাধারণ ইরানিদের তা বিশ্বাস করানো কঠিন হবে, এমন সম্ভাবনাও রয়েছে। ইরানিদের অনেকেই মনে করেন সরকারি ঘোষণা বিশ্বাস করা কঠিন।

জনগণকে বোকা বানানোর ক্ষেত্রে ইরানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আস্থাও নষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে ক্রমাগত দেশটির শাসকদলের নিজস্ব বার্তা প্রচার ও ভিন্নমতের সহিংস দমনের কারণে স্বচ্ছতা নষ্ট হয়েছে।

২০২০ সালের একটি ঘটনা প্রকৃত উদাহরণ হতে পারে। সে বছর জানুয়ারিতে কিয়েভে যাওয়ার পথে ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের পিএস-৭৫২ ফ্লাইটের একটি বিমান ১৭৬ জন আরোহী নিয়ে তেহরানের ইমাম খামেনি বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হয়। বিমানটিতে থাকা বেশিরভাগ যাত্রী ছিলেন ইরান এবং কানাডার নাগরিক। দুর্ঘটনায় সবাই মারা যান।

তেহরানের আশপাশে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল বিপ্লবী গার্ডস। তবে ঘটনার তিন দিন ধরে, সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কোনো প্রকার সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন। তাদের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র বিমানে আঘাত করার ভিডিও প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের দাবি ছিল, এটি একটি প্রযুক্তিগত দুর্ঘটনা।

রাইসির মৃত্যু নিয়ে প্রকাশিত বিবৃতি আরও বলা হয়েছে, ‘অনুমান নির্ভর যেকোনো প্রকার অনভিজ্ঞ মতামতের ওপর জনসাধারণকে বিশ্বাস না করার আহ্বান জানানো হলো। ঘটনা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে অথবা সাইবারস্পেস ও অন্যান্য মাধ্যমে বিদেশি মিডিয়া অনুমান নির্ভর তথ্য পরিবেশন করছে যা উপেক্ষা করতে বলা হলো।’

মোজতবা খামেনির পথ পরিষ্কার

খামেনির পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার প্রতিযোগীতায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট রাইসি ও খামেনির বড় ছেলে মোজতবা খামেনি। রাইসি মারা যাওয়ায় মোজতবা খামেনির পথ এখন অনেকটাই পরিষ্কার।

ইরানের রাজনীতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইব্রাহিম রাইসিকে পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা বানানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। এখন এই দায়িত্বের একমাত্র উত্তরসূরী খামেনির বড় ছেলে।

মোজতবাকে উত্তরাধিকার বানানোর পরিকল্পনার শক্তিশালী ইঙ্গিত পাওয়া যায় গত মাসে প্রকাশিত একটি ছবি থেকে। ছবিতে দেখা গেছে পাগড়িধারী আলেম এবং সজ্জিত জেনারেলদের সামনে একটি চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছেন খামেনি।

ছবিতে আরও দেখা গেছে খামেনির ঠিক ডান পাশে বাদামী পোশাক পরে বসে আছেন তার বড় ছেলে। ইরানের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে কয়েক বছরের মধ্যে এটি ছিল মোজতবার প্রথম নথিভুক্ত উপস্থিতি। মোজতবার ডানে ছিলেন প্রয়াত রাইসি।

ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট কে হবেন

ইতোমধ্যে দেশটির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মধ্যপন্থী প্রার্থীদের পরবর্তী নির্বাচনের অংশ নেওয়ার বেলায় অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

কট্টরপন্থী এবং প্রভাবশালী গার্ডিয়ান কাউন্সিল থেকে অনেকের নাম শোনা গেছে। এর মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানীও রয়েছেন। তাকে তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে মোজতবার (৫৪) পথ প্রশস্ত হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

ফার্সি ভাষায় মোজতবা নামের অর্থ ‘নির্বাচিত’। রাইসির মৃত্যুর আগেও মোজতবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। তার নেতৃত্বে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং দুর্নীতির কারণে অনেকেই বেজার ছিলেন।

১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে ইরাক-ইরান যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে কাজ করার সময় সাত দিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায় ১৭ বছর বয়সী কিশোর মোজতবা। তখনও ইরানের সর্বোচ্চ নেতার আসনে বসেননি আয়াতুল্লাহ খামেনি। নিখোঁজ হওয়ার পরই প্রথমবার জনসমক্ষে আলোচনায় আসেন মোজতবা।

তারপর আর উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ঘটনাই মোজতবা ঘটাননি যাতে মনে হতে পারে ভবিষ্যতে র‌্যাংকে আসতে পারেন তিনি।

যুদ্ধের সময়কার স্মৃতিকথায় আইআরজিসির একজন কমান্ডার আলী ফজলি লিখেছেন, ‘সেসময় যদি সে (মোজতবা) মারা যেতো তাতে আমাদের কোনো সমস্যা হতো না। তবে যদি তাকে বন্দী করা হতো তবে প্রচারণার কারণে আমাদের তার জন্য চড়া মূল্য দিতে হতো।’

মোজতবাকে পরে ইরাকের সীমান্ত থেকে উদ্ধার করা হয়। তারপর থেকে সরকারের কোনো পদস্থ কর্মকর্তা না হয়েও সে সবসময় ফোকাসে চলে আসতে সক্ষম হয়। আইআরজিসির একজন সদস্য ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফকে বলেছেন, ‘শীর্ষ কমান্ডাররা তাকে নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য করছেন।’

ইরানের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক বলেন, তিনি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন যে বিপ্লবী গার্ডের কমান্ডারের সঙ্গে প্রতিদিন গোপন বৈঠক করেন।

মোজতবা অন্তত দুবার সফলভাবে রাজনীতির মাঠে ছক্কা হাঁকিয়েছেন। প্রথমবার ২০০৫ সালে আর পরেরবার ২০০৯ সালে। ধারণা করা হয়, সেবার মাহমুদ আহমাদিনেজাদের পক্ষে নির্বাচনে কারচুপি করেছেন তিনি। আহমাদিনেজাদ ২০১৩ সাল পর্যন্ত আট বছর ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

মোজতবার নেতৃত্ব দেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে তার কট্টরপন্থী বাবার নীতি, সেইসাথে তার নিজের অভ্যন্তরীণ বৃত্ত থেকে। এই দলটিতে ইরানের চরম আদর্শিক ধর্মগুরুদের যোগাযোগ রয়েছে।

আটলান্টিক কাউন্সিলের ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুসারে, এর মধ্যে রয়েছেন বিপ্লবী গার্ডের সাবেক গোয়েন্দা প্রধানের ভাই মেহেদী তায়েব, বিপ্লবী গার্ডের ব্রেইনওয়াশের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী আলিরেজা পানাহিয়ান এবং ইসলাম প্রচার সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ কওমি।

১৯৮৯ সালে খামেনির উত্তরাধিকার হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তার ছেলে মোজতবা। ২০২২ সালের শেষের দিকে ইরানে বিক্ষোভের সময় মোজতবা খামেনির মৃত্যু চেয়ে স্লোগান দিয়েছিল জনতা। তারা বলেছিল, ‘মোজতবা, আপনি মরবেন; আপনি কখনই নেতৃত্বে আসতে পারবেন না।’

কট্টরভাবে সেবার বিক্ষোভকারীদের দমন করা হয়েছিল। হয়তো এবারও বিক্ষোভ হলে সেভাবেই দমন করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, রাইসির জায়গায় যদি মোজতবাকে নির্বাচিত করা হয় তাহলে হয়তো আবারও বড় কোনো বিক্ষোভ দেখবে ইরান।

তেহরানের আধাসামরিক গোষ্ঠী বাসিজের একজন সদস্য বলেছেন, ‘বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে প্রতিবাদগুলো দমন করা হয়েছে রাইসির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হয়তো তা নতুন মাত্রায় দেখা দেবে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Monir Hossain

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ